SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or

Log in with Social Account

Admission
বাংলা সাহিত্য - কবিতা - তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা

তোমাকে পাওয়ার জন্যে

আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?

আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?

তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,

সাকিনা বিবির কপাল ভাঙল,

সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর।

তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,

শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক এলো

দানবের মতো চিৎকার করতে করতে

তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,

ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড় হলো । রিকয়েললেস রাইফেল

আর মেশিনগান খই ফোটাল যত্রতত্র।

তুমি আসবে বলে ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম ।

তুমি আসবে বলে বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভুর বাস্তুভিটার

ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করল একটা কুকুর ।

তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,

অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতা-মাতার লাশের উপর ।

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে 

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা

আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?

আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?

স্বাধীনতা, তোমার জন্যে থুথুড়ে এক বুড়ো

উদাস দাওয়ায় বসে আছেন – তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্ণের

দুর্বল আলোর ঝিলিক, বাতাসে নড়ছে চুল ।

স্বাধীনতা, তোমার জন্যে

মোল্লাবাড়ির এক বিধবা দাঁড়িয়ে আছে

নড়বড়ে খুঁটি ধরে দগ্ধ ঘরের।

স্বাধীনতা, তোমার জন্যে

হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে

বসে আছে পথের ধারে ।

তোমার জন্যে,

সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,

কেষ্ট দাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,

মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,

গাজী গাজী বলে যে নৌকা চালায় উদ্দাম ঝড়ে,

রুস্তম শেখ, ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস 

এখন পোকার দখলে

আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুরে-বেড়ানো

সেই তেজি তরুণ যার পদভারে

একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে –

সেই তেজি তরুণ যার পদভারে

সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।

পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত

ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,

নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক

এই বাংলায় তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।
                                                                               (সংক্ষেপিত)
 

Content added || updated By

শামসুর রাহমান ১৯২৯ সালের ২৪শে অক্টোবর ঢাকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার পাড়াতলী গ্রাম। তাঁর পিতা মোখলেসুর রহমান চৌধুরী ও মাতা আমেনা খাতুন। তিনি ১৯৪৫ সালে ঢাকার পোগোজ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর পেশা ছিল সাংবাদিকতা। তিনি একনিষ্ঠভাবে কাব্য সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের প্রত্যাশা, হতাশা, বিচ্ছিন্নতা, বৈরাগ্য ও সংগ্রাম তাঁর কবিতায় সার্থকভাবে বিধৃত। তাঁর কবিতায় অতি আধুনিক কাব্যধারার বৈশিষ্ট্য সার্থকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। উপমা ও চিত্রকল্পে তিনি প্রকৃতিনির্ভর এবং বিষয় ও উপাদানে শহরকেন্দ্রিক। তাঁর প্রধান কাব্য : প্ৰথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে, রৌদ্র করোটিতে, বিধ্বস্ত নীলিমা, নিরালোকে দিব্যরথ, নিজ বাসভূমে, বন্দী শিবির থেকে, দুঃসময়ের মুখোমুখি, ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, এক ধরনের অহংকার, আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি, আমি অনাহারী, বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে, দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে, বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়, গৃহযুদ্ধের আগে, হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো, হরিণের হাড়, মানব হৃদয়ে নৈবেদ্য সাজাই ইত্যাদি। এছাড়া তাঁর কিছু অনুবাদ-কবিতা ও শিশুতোষ কবিতা রয়েছে। শামসুর রাহমান তাঁর অনন্যসাধারণ কবি-কীর্তির জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। তিনি ১৭ই আগস্ট, ২০০৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
 

Content added By

খাণ্ডবদাহন – খাণ্ডব মূলত মহাভারতের একটি বিখ্যাত অরণ্য, যা আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। নির্বিচারে ধ্বংস করা হয়েছিল অরণ্যের প্রায় সকল প্রাণিকে । এ কবিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞকে খাণ্ডবদাহন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর – মুক্তিযুদ্ধের শহিদ হয়েছেন হরিদাসীর স্বামী। এ কারণে বিধবা হরিদাসীর সিঁথি থেকে সিঁদুর - মুছে ফেলতে হয়েছে । সনাতন ধর্মের বিবাহকেন্দ্রিক সংস্কৃতিতে সধবারা সিঁদুর পরেন, স্বামীর মৃত্যু হলে সিঁদুর মুছে ফেলতে হয়। হরিদাসীকেও হতে হয়েছে সিঁদুরবিহীন। যত্রতত্র – যেখানে সেখানে, সব জায়গায়, তুমি আসবে বলে...ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড় হলো – নয় মাসব্যাপী সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদান বাহিনি নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে। ধ্বংস করেছে ছাত্রাবাস, বস্তি। কারণ ছাত্রজনতার প্রবল প্রতিবাদ আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল ছাত্রাবাস ও বস্তি । হানাদার বাহিনি ও তাদের দোসররা চেয়েছিল প্রতিরোধের সংগ্রামকে স্তব্ধ করে দিতে। তাই তারা পুড়িয়ে দিয়েছিল গ্রাম ও শহর। নারকীয় এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল বাঙালি জাতিকে । প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে অপরিসীম আত্মত্যাগের মাধ্যমে। থুথুড়ে এক বুড়ো - বয়সের ভারে বিধ্বস্ত লোক, যার বয়স অনেক হয়েছে এবং চলাচল করতে যার কষ্ট হয়; রুস্তম শেখ এখন পোকার দখলে – রুস্তম শেখ নামের এক রিকশাওয়ালা, যিনি যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন। মৃত অবস্থা বোঝানোর জন্য বলা হয়েছে ‘যার ফুসফুস এখন পোকার দখলে'।
 

Content added || updated By

‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা' শীর্ষক কবিতাটি শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা নামক কাব্য থেকে নেওয়া হয়েছে। কবিতাটি কবির বন্দী শিবির থেকে নামক কাব্যের অন্তর্ভুক্ত। স্বাধীনতা শুধু শব্দমাত্র নয়, এটি এমন এক অধিকার ও অনুভব যা মানুষের জন্মগত। কিন্তু এই অধিকার আদায়ের জন্য বাঙালি জাতিকে দীর্ঘ কাল যেমন সংগ্রাম করতে হয়েছে তেমনি করতে হয়েছে অপরিসীম আত্মত্যাগ । ১৯৭১ সালে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামে আপামর বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যুদ্ধচলাকালে বাঙালির রক্তে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয় পাকিস্তানি যুদ্ধবাজরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে সকিনা বিবির মতো গ্রামীণ নারীর সহায়-সম্বল-সম্ভ্রম বিসর্জিত হয়েছে, হরিদাসী হয়েছে স্বামীহারা, নবজাতক হারিয়েছে মা-বাবাকে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ছাত্রাবাস আক্রমণ করে ছাত্রদের হত্যা করে, শহরের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে গণহত্যা চালায়, পুড়িয়ে দেয় গ্রাম ও শহরের লোকালয়। এর প্রাকৃতিক প্রতিবাদ ওঠে পশুর কণ্ঠেও। আর্তনাদ করে কুকুরও। মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিক, কৃষক, জেলে, রিক্শাওয়ালা প্রমুখ সাধারণ মানুষ আত্মত্যাগ করে । দগ্ধ হওয়া লোকালয় প্রবীণ বাঙালির আলোকিত চোখে অগ্নি ঝরায় । সেইসঙ্গে নবীন রক্তে প্রাণস্পন্দন ও আশা জেগে থাকতে দেখে কবি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেন— এত আত্মত্যাগ যার উদ্দেশ্যে সেই স্বাধীনতাকে বাঙালি একদিন ছিনিয়ে আনবেই। কবিতাটি মুক্তিযুদ্ধের অনবদ্য সাহিত্যিক দলিল ।
 

Content added By